বাংলাদেশের নাগরিকদের সঞ্চয়ের মানসিকতা বেশ ভালো বলা যায়। আমাদের দেশের সমাজ ব্যবস্থায় ছোটবেলা হতেই সঞ্চয়ী মনোভাব গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয়। বিশেষ করে মধ্যবিত্তের জন্য এটি বেচে থাকার অন্যরকম অভিপ্রায়। ছোট ছোট সঞ্চয় দিয়ে আমরা আমাদের অনেক স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে শিখে যাই। যে কোন বড় ধরনের বিপদে এটি আমাদের অনেকটা সাহায্য করে।
সঞ্চয়পত্র
আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা আর যাই হোক বর্তমানে আমরা অনেক কিছুই মিলিয়ে নিতে পারি না। তাই ভবিষ্যতে যেনো যে কোন ধরনের আপদকালীন সময়ে অর্থনৈতিক সাহায্যের জন্য কারোর কাছে হাত পেতে দাড়াতে না হয়, কিংবা কোন একটি উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে কিছু টাকা গচ্ছিত রাখাও আমাদের নিত্যদিনের অভ্যেস। আর এই অভ্যেস যাদের আছে তারাই একটা সময়ে নিজেকে সামলে নিতে পারেন।
সঞ্চয় আমরা নানান উপায়ে করে নিতে পারি। তবে যার যার সামর্থ অনুযায়ী আমরা চেষ্টা করে থাকি সঞ্চয়ের জন্য। কেউ ব্যাংকে টাকা জমা রাখেন, কেউ গহনা কেনে আর কেউ বা সম্পত্তি কিনে। এটা নির্ভর করে আমাদের সামর্থ অনুযায়ী। কেউ আবার ব্যবসায় ঝুঁকি নিয়ে থাকি। তবে এটা নির্ভর করে আপনার ভবিষ্যত পরিকল্পনার উপরে।
সঞ্চয়ের বিপরীতে আমরা নানান রকমের সাহায্য পেতে পারি। ব্যবসায় ঝুঁকি থাকেই তাই লাভ-লস দুটোই হতে পারে। সম্পত্তি ক্রয়ে এটি একটা সময়ে আপনার জন্য দারুন লাভজনক হতে পারে, কিন্তু এটি এককালীন ভাবে পাবেন যখন আপনি এটি বিক্রয় করবেন। গহনাতেও একই অবস্থা যদিও সম্পত্তির মূল্য দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে ঠিক তেমনই গহনার দামও বেড়ে যাচ্ছে, কিন্তু এটার আবার কিছুদিন পর পর দাম ঊঠা-নামা করে। ব্যাংকে অনেকেই ফিক্সড ডিপোজিট করে রাখেন তবে একেক ব্যাংকের রেট একেক রকমের হয়।
তাই এদেশের মানুষ এখন সঞ্চয়পত্রের দিকে ঝুঁকেছে, কারণ এটি মেয়াদান্তের সময়ে আপনি মোটামুটি ভালো মুনাফা পাবেন। যারা রিটার্ড করেছেন, বা আর কোন মাধ্যম হতে টাকা পেয়েছেন কিন্তু অন্য কিছুতে তা বিনিযোগ করতে ভয় পান তাদের জন্য এটি ভালো সুযোগ, কারণ আপনি এর বিপরীতে ভালো একটা টাকা রিটার্ন পাচ্ছেন, যা দিয়ে আপনি হয়তো আপনার পরিবারের খরচ চালাতে দ্বিধা বোধ করবেন না। বাংলাদেশে নানান রকমের সঞ্চয় থাকলেও পারিবারিক সঞ্চয়পত্রে বেশিরভাগ মানুষের আকর্ষন কাজ করে।
২০২৩ সালের সঞ্চয়পত্রের নতুন নিয়ম
বাংলাদেশ সরকার তার বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজে লোন নিয়ে থাকে এটিও একটি মাধ্যম, তবে এর বিনিময়ে বিনিয়োগকারীদের ভালো অঙ্কের রিটার্ন দেয়া লাগে, যা অনেকটা ঋনপরিশোধের মতোই। আর এই ঋণ পরিশোধে সরকারকে বিশাল অঙ্কের টাকা দেয়া লাগে। সম্প্রতি সময়ে এই ক্ষেত্রে মানুষের বিনিয়োগের হার অনেকটা বেড়ে যাওয়ায়, বাংলাদেশ সরকারের এর চাপ বেড়েছে। তাই এর সুদের হার আনুপাতিকহারে কমানোর প্রচেষ্টায় নানামুখী পদক্ষেপ হাতে নিয়েছে।
আজকে আমরা জেনে নেয়ার চেষ্টা করবো ২০২৩ সালের সঞ্চয়পত্রের নতুন নিয়মে কি কি আছে। চলুন তাহলে জেনে নেয়া যাক।
আমি আগেও বলেছি যে, সঞ্চয়পত্রের বিপরীতে বাংলাদেশ সরকারকে প্রতি বছর হাজার কোটি টাকা খরচ করতে হয় তাই এবার এর লাগাম টেনে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। ২০২২ সালেও সরকার এর হার কমিয়েছিলো যার ফলে কিছুটা বিনিয়োগ কমেছে। এর ধারাবাহিকতায় ২০২৩ সালের নতুন অর্থ-বছরেও এর সুদের হার কমানো হয়েছে। যার ফলে বিনিয়োগের হার আরও কমে যাবে।
জনাব মাসুদুর রহমান, সহকারী পরিচালক, জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর সম্প্রতি গনমাধ্যমে জানিয়েছেন, নতুন আইন করার ফলে এক্ষেত্রে বিনিয়োগ কিছুটা কমেছে। কারণ সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এবার নতুন শর্ত জুড়ে দেয়া হয়েছে, যার ফলে অনেকেই এটাকে অতিরিক্ত ঝামেলা মনে করে বিনিয়োগে নিরুতসাহিত হয়েছে।
সঞ্চয়পত্রের নতুন নিয়ম ২০২৩ সালে কি কি পরিবর্তন এসেছে
প্রভিডেন্ট ফান্ড
প্রচলিত নিয়মে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যেখানে প্রভিডেন্ট ফান্ড কার্যকর আছে সেখানে সঞ্চয়পত্রে কেনাকাটার কোন নিয়ম ছিলো না আগে। তবে এবারের নতুন নিয়মে যে সকল প্রতিষ্ঠানের ব্যাংকের ফান্ডে টাকা জমা থাকবে তারা সেই টাকার ৫০ ভাগ টাকা এক্ষেত্রে বিনিয়োগ করতে পারবে। অর্থায় যদি কোন প্রতিষ্ঠানের ফান্ডে ১ কোটি টাকা থাকে তাহলে তারা ৫০ লাখ টাকা এক্ষেত্রে বিনিয়োগ করতে পারবেন। আর এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে যা ৫০ কোটি টাকা। হ্যাঁ কেউ চাইলে এর বেশি টাকা ইনভেস্ট করতে পারবে না।
ব্যক্তিক্ষেত্রে টি আই এন বাধ্যতামূলক
ব্যক্তি ক্ষেত্রে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ২ লাখ টাকার বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আগে টি আই এন সনদ বাধ্যতামূলক ছিলো, তবে এবারের নিয়মে এর পরিবর্তন হয়েছে তা অনেকের জন্য ভালো হয়েছে যেমন, আপনি এখন সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কর প্রদানের সনদ নাম্বার দেয়ার কোন বাধ্যবাধকতা নেই। এটা যেমন অনেকের জন্য ভালো হয়েছে তেমনই এর পরের ক্ষেত্রে বাকিদের জন্য একটু চিন্তা করার সময় এসেছে।
নতুন নিয়মে আপনি ৫ লাখ টাকার উপরে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করলে শুধুমাত্র টিন নাম্বার দিলেই হবে না আপনাকে আয়কর রিটার্ন দাখিলের প্রমাণ দিতে হবে।
অর্থাৎ আপনাকে আয়কর রিটার্ন এর প্রাপ্তিস্বীকারপত্র ও জমা দেয়া লাগবে
করদাতা হিসেবে আপনার রিটার্ন দাখিলের সনদপত্র জমা দেয়া লাগবে যেখানে আপনার করের
তথ্য আছে
সঞ্চয়পত্রের নতুন নিয়মে সরকারের কি কি সুবিধা পেতে পারে?
- প্রথমত নতুন করদাতা সনাক্ত করা যাবে
- ৫ লাখ টাকার উপর বিনিয়োগকারীর তথ্য পাওয়া যাবে
- কর প্রদানের সনদ বাধ্যতামূলক হবার কারণে এই ক্ষেত্রে বিনিয়োগ কিছুটা কমে আসবে যার ফলে সরকার এ ক্ষেত্রে যে সুদ প্রদান করতো তা কিছুটা হ্রাস পাবে।
যে কোন কিছুর সিদ্ধান্ত নেয়া হলে এতে কিছু মানুষের উপকার আসে আর কিছু মানুষের ক্ষেত্রে দুঃচিন্তা নেমে আসে। সঞ্চয়পত্রের নতুন নিয়ম ২০২৩ চালুর ফলে এর অনেক সুবিধা-অসুবিধা হয়েছে। যেমন যারা ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ করবেন পারিবারিক সঞ্চয়পত্রের ক্ষেত্রে এর মেয়াদান্তের সুদের হার অপরিবর্তিত থাকবে। তবে এর উপরে যারা বিনিয়োগ করবেন তাদের সুদের হার খানিকটা কমে আসবে। তাই এক্ষেত্রে যারা বিনিয়োগ করবেন তাদের ভেবেচিন্তে কাজ করা উচিত
সঞ্চয়পত্রে কেনাকাটা বিভিন্ন ব্যাংকের মাধ্যমে করা গেলেও ইসলামি ব্যাংকগুলোতে তা করা যাবে না। আর সঞ্চয়পত্রের অন্যতম মাধ্যম হলো পোষ্ট অফিস, তবে কেউ এখানে ১ লাখ টাকার বেশি দিয়ে সঞ্চয় করতে পারবেন না। এক লাখ টাকার উপরে হলে তাকে ব্যাংকে টাকা জমা দিয়ে চেকের মাধ্যমে বিনিয়োগ করতে হবে।
আজকের এই কলামের মাধ্যমে যদি আপনাদের আর কোন তথ্য জানার আগ্রহ জন্মে তাহলে কমেন্টস করে জানানোর জন্য অনুরোধ রইলো। আমার এই লিখা যদি আপনার ভালো লেগে থাকে তাহলে অপরকে এটি জানাতে সাহায্য করুন। পরবর্তি নিবন্ধন নিয়ে আবারো হাজির হবো। ততোক্ষন পর্যন্ত ভালো থাকুন।
সঞ্চয়পত্র সংক্রান্ত প্রশ্নবলি
পরিবার সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কি রকম?
পরিবার সঞ্চয়পত্র সবচেয়ে জনপ্রিয় একটি সঞ্চয় স্কীম। একজন ব্যক্তি ১ হতে সর্বোচ্চ ৫ বছর মেয়াদান্তের সঞ্চয়পত্র কিনতে পারেন। এক্ষেত্রে ৫ বছরের মেয়াদান্তের হিসেবে আপনি ১৫ লাখ টাকার বিপরীতে ১১.৫২%, ৩০ লাখ টাকার বিপরীতে ১০.৫০% হারে সুদ পাবেন। তবে ৩০ লাখ টাকার বিপরীতে আপনি ৯.৫০% ইন্টারেস্ট পাবেন।
আমার কোন টিন সার্টিফিকেট নেই আমি কি সঞ্চয়পত্র কিনতে পারবো?
বর্তমান নিয়মে একজন ব্যক্তি সঞ্চয়পত্র কিনতে ৫ লাখ টাকা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে তাকে টিন সার্টিফিকেট জমা দিতে হবে না। সে অনযায়ী আপনার টিন না থাকলে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে জমা দেয়া লাগবে না, কিন্তু এর উপরে করতে আপনার টিন বাধ্যতামুলক করা হয়েছে। এবার আপনি সিদ্ধান্ত নিন কোনটা আপনার করা উচিত।
আমি বেসরকারী চাকুরী করি কিন্তু আমাদের পেনশন এর কোন সিস্টেম নেই, এই ক্ষেত্রে আমি কি করতে পারি?
একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও কর্মচারীগণ কি কি সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবে তা নির্ধারণ করে সেই প্রতিষ্ঠান, আর বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে তেমন পেনশন স্কীম বেশি নেই। যদি আপনি পেনশন সুবিধা পেতে আগ্রহী হোন তাহলে আপনি পেনশনার সঞ্চয়পত্র নিতে পারেন। যদিও বর্তমান সরকার সার্বজনীন পেনশন পলিসি নিয়ে কাজ করছেন। হয়তো শীঘ্রই আমরা এর বাস্তবায়ন দেখতে পাবো।
আমি সঞ্চয়পত্র সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাই
আপনার আগ্রহের জন্য ধন্যবাদ, সঞ্চয়পত্র সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে বাংলাদেশ সরকারের জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের ওয়েবসাইট ভিজিট করতে পারেন, সেখানে আপনি বিস্তারিত জানতে পারবেন।